প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন কোভিড ১৯ এর মতই আরেকটা ফ্লু মহামারী পৃথিবীতে আঘাত হেনেছিল । ১৯২০ সন অবধি এই মহামারি ৫০ কোটিরও বেশি মানুষের মাঝে ছড়িয়েছিল যা ছিল তৎকালীন সমগ্র বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় এক চতুর্থাংশ। আনুমানিক দুই থেকে পাঁচ কোটি এবং কোন কোন হিসাব মতে দশ কোটির মত মানুষ এতে মৃত্যু বরণ করেছিল।
বিশ্বযুদ্ধের শেষ বছরে স্প্যানিশরা এই ফ্লু নিয়ে এতো বেশি লেখালেখি করছিলো যে রোগটির নামই হয়ে যায় শেষ পর্যন্ত স্প্যানিশ ফ্লু । এখন অবধি সারাবিশ্বে স্প্যানিশ ফ্লু নামে যার সর্বাধিক পরিচিতি।
বর্তমান কোভিডের উপসর্গের মতোই ছিলো সেই ফ্লুর উপসর্গ। তখনও মানুষ বলতো, হঠাৎ করেই অসুস্থ বোধ করতে লাগলাম। জীবনে নিজেকে কখনো এতো টা অসুস্থ মনে হয়নি। শরীরে প্রচণ্ড রকমের ব্যথা হচ্ছিল। ক্লান্তি আর অবসাদে একে বারে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছিলাম। গায়ে ছিল প্রচণ্ড জ্বর সাথে কাশি আর শ্বাস কষ্ট।”
সতর্কতা হিসাবে আজকের মতই তখনও মানুষ মুখে মাস্ক পরে ঘুরতেন, রুমালকে ভাঁজ করে মুখোশ লাগাতেন। মানুষ থেকে মানুষ দূরত্ব বজায় রাখতেন। হাত ধুতেন, সকালে ও বিকালে নাকের ভেতরে সাবান পানি ঢুকিয়ে পরিষ্কার করতেন।
ডাক্তারগণও জোর করে হাঁচি দিয়ে তারপর লম্বা শ্বাস নিতে বলতেন । সচেতন এবং রোগ প্রতিরোধের উপরই বেশি জোড় দিতেন। সাবধান থাকার পরামর্শ দিতেন।
প্রায় তিনটি বছর এই রোগটি পুরো পৃথিবীকে কাপিয়ে ১৯২০ সনের ডিসেম্বরে বিদায় নেয়। অথচ আশ্চর্য বিষয় কোন চিকিৎসা অথবা কোন ভ্যাকসিন ছাড়াই এই মহামারী নিজে নিজে শেষ হয়ে যায়। এর ভয়াবহতা এত মাত্রায় ছিল যে, একবার নয় তিন তিনটি ওয়েভে
এই ফ্লু আক্রমন করেছিল । মনে করা হচ্ছে কভিড১৯ও একইভাবে এ পৃথিবী থেকে সেভাবেই একদিন হয়তো বিদায় নেবে।
এবারের মত ১৯২৯ সনেও মহা অর্থনৈতিক হতাশা বা ডিপ্রেশন শুরু হয়েছিল সারা বিশ্ব ব্যাপী। আমেরিকার বেকারত্ব দাঁড়ায় ২৫%। বিশ্ব জিডিপি ২৭% হ্রাস পায়। বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রায় ধস নেমে পড়ে।
প্রথম বিশ্ব যুদ্ধে ২২ থেকে ৫০ মিলিয়ন লোক মারা গিয়েছিলো, ভারতবর্ষের ৭৪ হাজার সৈন্য নিহত হয়েছিলো। ১৯৩৯ সনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়, ৭৫ মিলিয়ন লোক যুদ্ধে মারা যায়, কোরিয়ান যুদ্ধে বেহিসেবি লোক মরো যায়। ভিয়েত নাম যুদ্ধ ২০ বছর স্থায়ী হয় সংঘর্ষে ৪ মিলিয়ন লোক মরো যায়। এখন যাহারা ১৯৮০ বা ১৯৮৫ সনে ছোট্ট ছিলেন তখন কেউ হয়তো ভাবেন নি আপনার ৮৫ বছর বয়সের দাদা বা নানা কি কঠিন সময় আর সহজ মৃত্যু তোরণড়িয়ে এসেছেন?
কিন্তু কিভাবে সম্ভব হয়েছে? এখন সে বিষয়ে কিছু কথায় অাশা যাক: অার সে বিষয়টির মুলে ছিল জল দৃষ্টিভঙ্গি’র! মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির একটি আশ্চর্যজনক শক্তি ও যোগ্যতা আছে। সময়ের সাথে সাথে প্রতিটি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় মানুষকে এটি ক্ষেপনাস্ত্রের মত শক্তি যোগায়।
তাই এই করোনা পরিস্থিতি উত্তোরণেও অামাদের দৃষ্টিভঙ্গি হতে হবে পরিশ্রুত, পরিশিলিত এবং প্রতি মুহুর্তে আলোকিত করতে হবে আমাদের এই দৃষ্টিভঙ্গীকে। নিজের ওপর অসম্ভব রকম বিশ্বাস রাখতে হবে। কোন ক্রমেই কোন অবস্থাতেই মনবল হাড়ালে চলবে না। এককথায় মোটেই ভয় পাওয়া যাবে না। মনে রাখতে হবে যে, ভয় পেলেন তো হেরে গেলেন।
আর মৃত্যু! আমার আপনার নির্ধারিত সময় এবং নির্ধারিত পদ্ধতির বাইরে আমরা কেউ চাইলেও কিন্তু মৃত্যু বরণ করতে পারবোনা তা আমি যে ধর্মেরই হই না কেন, আর সেটি আস্তিক হই বা নাস্তিক যেই হই না কেন।
আমাদের চারপাশে যা কিছু ঘটছে তা আমার পছন্দের হোক, অথবা আমার বিরক্তির হোক, অভিসম্পাতের হোক, কোনভাবেই যেন আমরা হতাশাগ্রস্ত না হই। সব সময় যেন ভাবি এর চেয়েও খারাপ তো কিছু হতে পারতো অামার জন্য।
হিরোশিমা নাগাসাকি, সিরিয়া, ইরাক, ইয়েমেন, আফগান যুদ্ধ, জাপানের সুনামি, আফ্রিকার খরা থেকে কত না মানুষ বেঁচে অাছেন। এদের সবার মতো আপনি আমিও বাঁচবো। বাঁচতে হবেই সব প্রতিকূল তার বিরুদ্ধে আমাদেরকে এবং সেটি যুদ্ধ করে হলেও
হোক।
এটি নিশ্চিত যে করোনা ভ্যাকসিন আসবে দেরীতে, ধরেই নেই আমি হয়তো টেস্ট করার সুযোগই পাবো না, ধরেই নেই এই রোগের চিকিৎসা পাবার সুযোগ আমার হয়তো হবে না, কিন্তু আমি যদি সাহস রাখি আর ভয় না পাই এবং সব কিছুতে দৃষ্টি ভঙ্গিটি ইতি বাচক রাখি, করোনা আক্রান্ত হলেও সৃষ্টিকর্তা আপনাকে আমাকে আয়ু দেবেন, আমাকে বাঁচিয়ে রাখবেন তার আশ্চর্য কুদরতি ক্ষমতা দিয়ে।
সবচেয়ে বড় ইতিবাচক বিষয় হলো সৃষ্টি কর্তার অজানা বৈজ্ঞানিক কুদরতের উপর ভরসা
রাখা। ডাক্তার আমাকে সব রকমের ওষুধ দিতে পারেন কিন্তু শরীরের ভেতরে সেই ওষুধ কাজ করাবেন একমাত্র সৃষ্টি কর্তা। আবার সেই একই সৃষ্টিকর্তা আপনা কে, আমাকে ওষুধ ছাড়াও সুস্থ করে দিতে পারেন। যেটাকে আমরা বলি ইম্যুনিটি। এই ইম্যুনিটি এমনি একটি মহা জাগতিক অতি রহস্যময় শক্তির ব্যাপার।
আমি চাইলেও আমার নাগালের মধ্যে সব দরকারি সেবা সহজে আসবেনা, আসা সম্ভব নয়, আমাকে তা মেনে নিয়ে আত্ম বিশ্বাসের শক্তিতে বলীয়ান থাকতে হবে। বিশ্বাস রাখতে হবে যে সৃষ্টিকর্তার দেয়া ইম্যুনিটি আমাকে সুস্থ রাখবে। আমি যতদূর পারি শুধু স্বাস্থ্যবিধি সকল মানবো কঠোরভাবে।
সুতরাং ভালো থাকবো এবং নিজেকে ভাগ্যবান ভাবতে শুরু করবো, যতক্ষণ মাটির উপর বেঁচে থাকতে পারি ততক্ষণই আমরা আসলে ভাগ্যবান এবং বিজয়ী।
লেখক: রফিকুল ইসলাম সরকার
(ছড়াকার, কবি, কলামিস্ট, উন্নয়ন কর্মী)