যশোর শহরতলী খোলাডাঙ্গার মনিরা নামে এক পেশাদার সুদখোরের অত্যাচার-নির্যাতনে জর্জরিত হচ্ছে এলাকার সংখ্যালঘু অসহায় অনেকগুলো পরিবার। অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে ফাঁকা স্ট্যাম্প ও চেক নিয়ে জিম্মি করে ভিটেমাটি লিখে নেয়া,এলাকা ছাড়া করা, মারপিট ও নির্যাতনে স্ট্রোক করে মৃত্যুর মতও ঘটনা ঘটেছে। মানববন্ধন ও পুলিশের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েও রেহাই পাইনি ভুক্তভোগীরা। এমন ঘটনা নিয়ে সংখ্যালঘু পরিবারে নির্যাতিতা ৭ মহিলা পৃথকভাবে মামলা দায়ের করেছে যশোর আদালতে।
৯ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার যশোর কোতয়ালী আমলি আদালতের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মঞ্জরুল ইসলাম মামলা গ্রহণ করেন এবং মামলাটির তদন্তভার দেন পিবিআই কে। আদালতে নির্যাতিতা ৭ মহিলার পক্ষে মামলা দায়ের করেন ব্যারিস্টার কাজী রেফাত রেজওয়ান সেতু। ৭ টি মামলায় পৃথকভাবে বাদি হয়েছেন যশোর সদর উপজেলার খোলাডাঙ্গা গ্রামের রঞ্জনের স্ত্রী ভাদুরী রাণী, মৃত ধনী কর্মকারের স্ত্রী প্রমিলা কর্মকার, খোকন সরদারের স্ত্রী ইলা সরদার, শংকর কর্মকারের স্ত্রী চঞ্চলা কর্মকার, মৃত নিমাই কর্মকারের স্ত্রী ভুলামনি কর্মকার, শংকর কর্মকারের স্ত্রী রিতা রাণী, মৃত কমল কস্তার স্ত্রী রুপালী কস্তা। মামলায় আসামী করা হয়েছে একই গ্রামের রবিউল ইসলামের স্ত্রী মনিরা বেগমকে।
মামলার বিবরণে জানা যায়, মনিরা বেগম একজন চিহিৃত পেশাদার সুদখোর। বাদীরা প্রত্যেকে এলাকার সহজ-সরল অসহায় হিন্দু -খ্রিস্টান সংখ্যালঘু পরিবারের। বিভিন্ন সময় পরিবারের অসহায়ত্বের সুযোগে এসব পরিবার অভিযুক্ত মনিরার কাছ থেকে সুদে টাকা গ্রহণ করে। টাকা নেয়ার সময় এসব পরিবারের কাছ থেকে ফাঁকা চেক ও নন-জুডিশিয়াল স্টাম্প নিয়ে জিম্মি করে চড়া সুদের ফাঁদে ফেলে নিঃস্ব করে দিয়েছে। চক্রবৃদ্ধিহারে সুদের টাকা দিতে গিয়ে পরিবারগুলো যেমন এনজিও লোনে জর্জরিত হয়েছে, তেমনি মনিরার নানামুখী অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। শারীরিক- মানসিক নির্যাতন, স্থানীয় গুন্ডা বাহিনী দিয়ে খুন, গুমের হুমকি, ভিটেমাটি লিখে নেয়া, সোনার গহনা ছিনিয়ে নেয়াসহ নানামুখী অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ভুক্তভোগীরা গত ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখে ধর্মতলায় মানববন্ধন করে স্থানীয় মেম্বারের কাছে লিখিত অভিযোগ করে। তাতে কোন কিনারা না পেয়ে ৭ নভেম্বর ২০২১ তারিখে যশোরের পুলিশ সুপারের কাছে লিখিত অভিযোগ করলে ডিবির এস আই সোলাইমানকে মিমাংসার দায়িত্ব দেয়। তিনি দায়িত্ব নিয়ে মনিরাকে তিরস্কার করে স্টাম্প ও চেক ফেরত দিতে বললেও মনিরা ও তার গুন্ডা বাহিনী কোন কর্ণপাত করেনি। এক পর্যায়ে পুলিশ সুপার ভুক্তভোগীদের মামলা করতে বলেন।
একটি মামলার বাদি ভাদুরী বলেন, মনিরা সাতক্ষীরা থেকে প্রথম স্বামী ছেড়ে এখানে এসে দ্বিতীয় স্বামীর সাথে ভাড়া বাসায় থাকতেন। পরি ঐ বাড়িওয়ালাকেও জিম্মি করে বাড়ি নিজের নামে করে নিয়েছে। তার সুদের জালে পড়ে কয়েকজন ভারতেও চলে গেছে।
মামলার বিবরণে আরো জানা যায়, প্রমিলা ১৫ হাজার টাকা নিয়ে ৭০ হাজার টাকা পরিশোধ করে এবং মনিরার কাছে আরো ২ লাখ ২০ টাকা সিরিয়াল করে জমা করে। এরপরও ২ লাখ টাকা দাবি করে স্টাম্প দিয়ে মামলার হুমকি দিচ্ছে। ইতিমধ্যে তার মানসিক অত্যাচারে ছেলে মধু স্ট্রোক করে মারা গেছে।
ইলা সরদার ৫ জুলাই ২০১৬ তারিখে চিকিৎসার প্রয়োজনে স্টাম্প করে ৩৫ হাজার টাকা নিয়ে ১ লাখ ৩৫ হাজার টাকা পরিশোধ করলেও আরো ৫ লাখ দাবি করে। পরবর্তীতে ২ সেপ্টেম্বর আরো ৮৮ হাজার টাকা গুন্ডা বাহিনী লেলিয়ে দিয়ে জোর পূর্বক নিয়ে যায়। এছাড়া মনিরার সাথে সিরিয়ালে ২৮ হাজার বাদীর পাওনা রয়েছে। কিন্তু এখনো পাওনা দাবি করে স্টাম্প ফেরত না দিয়ে হুমকি দিচ্ছে।
চঞ্চলা কর্মকার মেসে রান্না করে, পরিবারের প্রয়োজনে ২০১৫ সালে ১৫ হাজার টাকা নিয়ে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৬৯ হাজার টাকা পরিশোধ করে ও মনিরার কাছে ২২ হাজার টাকা সিরিয়ালে জমা আছে। এরপরও ২ লাখ টাকা দাবি করেছে।
ভাদুরী রাণী ২০১৮ সালে মেয়ের অপারেশন করার জন্য ৮০ হাজার ও পরে আরো ৪০ হাজার টাকা নিয়ে পরবর্তী সময়ে ৫ টি এনজিও থেকে ৫ লাখ টাকা পরিশোধ করে। টাকা নেয়ার সময় ৪ টি চেক রেখে টাকা নেয়। ৫ লাখ পরিশোধের পর আরো টাকা দাবি করলে আরআরএফ এনজিও থেকে আরো ৭০ হাজার টাকা লোন নিয়ে পরিশোধ করে। তারপর ৭ সেপ্টেম্বর মনিরার গুন্ডা বাহিনী বাড়িতে এসে বাদীকে মারপিট করে।
ভুলামনি কর্মকার একজন শাকপাতা বিক্রেতা। স্বামীহীন অসহায় পরিবারের প্রয়োজনে ৮ হাজার টাকা নিয়ে কিস্তিতে ৫০ হাজার টাকা পরিশোধ করে। এরপর আরো টাকা দাবি করে তার একমাত্র ভিটেবাড়ির ১.৫ শতক জমি জোর পূর্বক স্টাম্প করে নেয়। তাতে ক্ষ্যান্ত না হয়ে বাড়ি দখলের জন্য এসে ভুলামনির পরিবারর আসবাবপত্র, থালা-বাটি নিয়ে যায়। মানসিক অত্যাচারে ছেলে লিটন সম্প্রতি মারা যায়।
রিতা রাণী কর্মকার আরআরএফ এনজিওতে আয়ার কাজ করে। ২০১৭ সালে পরিবারের প্রয়োজনে চেক জিম্মা রেখে ১০ হাজার টাকা নেয়,পরে ৩ টি এনজিও থেকে ২ লাখ টাকা লোন নিয়ে পরিশোধ করলেও এখনো ৫ লাখ টাকা দাবি করছে। এরপর মনিরার পোষ্য গুন্ডা বাহিনী জোর করে ২ জোড়া কানের দুল, ১ টি আংটি বাদির কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়।
রুপালী কস্তা স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকে টিউশনি করে জীবিকা নির্বাহ করে।২০১৮ সালে ফাকা চেক ও আইডি কার্ড রেখে ৩০ হাজার টাকা নেয়। দুই বছরে ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা পরিশোধ করার পর আরো ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা দাবি করে খুনের হুমকি দিচ্ছে।
মামলা প্রসঙ্গে ব্যারিস্টার কাজী রেফাত রেজওয়ান সেতু বলেন, অসহায় নিযার্তিত সংখ্যালঘু পরিবারের পাশে দাঁড়াতে ও সামাজিক অবক্ষয় রুখতে নামমাত্র খরচে এই মামলা লড়ছি। সুদের বিপক্ষে ৭ পরিবারের এমন আইনি লড়াইয়ে আসাকে সাধুবাদ জানাই।