আমীন রুহুল
বৈষয়িক মহামারী করোনার প্রভাবে আগামী দিনে বিশ্বে আরো প্রায় ৪০ কোটি মানুষ চরম তম দারিদ্র্যের শিকার হবে বলে জাতিসংঘের অধীনে থাকা ইউএনইউ-ওয়াইডার একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছে। প্রতিদিন লকডাউনের ফলে আয়ের উপর যে প্রভাব পড়ছে তাতেই সৃষ্টি হবে এ সংকট। এই সংকটে গোটা বিশ্বের মত বাংলাদেশও। বাংলাদেশ এসডিজি বাস্তবায়নের যে সূচকেই অবস্থান করুক না কেন,অথবা মাধ্যম আয়ের দেশের তকমা গায়ে লাগলেও দেশে এখনো অর্থনৈতিক শ্রেণী বৈষম্য চরম। ২০১৯ ও ২০২০ সালে দেশে কোটিপতি সৃষ্টি হওয়ার দৌড় তা প্রমাণ করে। বর্তমানে বাংলাদেশে কোটিপতির সংখ্যা ৮৪ হাজার। তবে অর্থনৈতিক উন্নয়নের চালকের আসনে বাংলাদেশ এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। তার পাশাপাশি এটাও বলতে হচ্ছে বাংলাদেশে করোনার প্রভাবে দারিদ্র্যতার হার ২০ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৫ বছর আগের মত ৪০ শতাংশ হতে পারে বলে মনে করছে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষণা বলছে বাংলাদেশে দেড় কোটি মানুষ চাকরি হারাতে পারে।
যাক কথা আর এদিকে বাড়াতে চাই না। মহামারী যত বাড়ছে সংকট তত প্রকট হচ্ছে। সংকট আর আশংকায় মানবজাতি আজ দিশেহারা। দিশেহারা অর্থনৈতিক সেক্টর- ব্যাংক,বীমা ও এনজিও। হিসাব চলছে আগামী দিনে টিকে থাকার। বেতন কমানো, কর্নী ছাটাই, বিনা বেতনে ছুটি এসব খবর এখন চারিদিকে। এসবের মধ্যে আশার আলো খুঁজতে হবে। বেঁচে থাকতে হবে,বাঁচিয়ে রাখতে হবে-মানুষ এবং মানুষের কাজের জায়গাকে। এ কারণে চিন্তার জায়গাতে এনজিও সেক্টর। বাংলাদেশের এনজিওগুলোর করোনাকালে কি করণীয় হবে তা একটু ভেবে দেখা।
প্রথমত আমি বলব এনজিও গুলোকে করোনাকালে টিকে থাকতে হবে। টিকে থাকাতাই একটা যুদ্ধ। এই যুদ্ধে যারা জয়ী হবে আগামী দিন তাদের। মনে রাখা দরকার যার শুরু আছে তার শেষ আছে। শেষ থেকে আবার শুরু হয়। লেখার শুরু থেকে যত সংকটের কথা,যত আশংকার কথা বলে এসেছি তার সবই এনজিওর জন্য হবে আশীর্বাদ। এনজিও সৃষ্টি হয়েছে সংকট মোকাবিলা করার জন্য, সেবার জন্য, সরকারকে সহযোগিতা করার জন্য, সর্বপরি দেশ পূর্ণগঠনে অবদান রাখার জন্য। আর এই সত্য ১৯৭১ পরবর্তী বাংলাদেশের মানুষের কাছে প্রমাণিত। তবে এ জন্য এনজিও গুলোকে টিকে থাকতে হবে করোনাকালে। আর করোনা পরবর্তীতে পরিবর্তন করতে হবে পরিকল্পনা। আমরা সকলেই জানি বাংলাদেশেকে মাধ্যম আয়ের দেশ বলার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ থেকে দাতাগোষ্ঠী বিদায় নিতে শুরু করেছিল।
কমতে শুরু করেছিল দাতাগোষ্ঠীর দেয়া ফান্ড বা বাংলাদেশেকে নিয়ে নতুন পরিকল্পনা। কিন্তু করোনা পরবর্তী বাংলাদেশেকে নিয়ে দাতাগোষ্ঠীকে পূণরায় আবার ভাবতে হবে। বাড়বে কাজের সুযোগ। মনে প্রশ্ন জাগতে পারে গোটা বিশ্ব যখন মহামারীতে, বিশ্ব অর্থনীতি যখন তলানিতে তখন দাতা হবে কে? তাদের জন্য বলছি, অর্থব্যবস্থা একদিকে ভেঙে পড়ে অন্যদিকে তখন পুঞ্জিভূত হয়। মনে রাখতে হবে টাকা কারো না কারো হাতে চলে যাচ্ছে। এই মহামারীকে কেন্দ্র করে অর্থ যাদের হাতে পুঞ্জিভূত হবে তাদের কাছ থেকে কাজ শুরু হবে। এই মহামারীর শিক্ষা নিয়ে গোটা বিশ্ব স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নড়ে বসবে না এটা ভাবা বোকামি নয় কি? তাই এনজিও গুলোকে এখনই ভাবতে হবে প্রজেক্ট প্রস্তাবনা নিয়ে,নতুন চিন্তা, নতুন মেধাকে কাজে লাগাতে হবে।
বাংলাদেশে এমআরএ লাইসেন্স নিয়ে কাজ করছে ৭৫৮ টি প্রতিষ্ঠান। যারা সাড়ে তিন কোটি মানুষকে জামানত বিহীন লোন সহায়তা দিয়ে চলেছে। তিন থেকে চার লাখ মানুষ কর্মরত এসব প্রতিষ্ঠানে। এই সেক্টরকে বেঁচে থাকতেই হবে।তাই বর্তমান সময়ে টিকে থাকার জন্য নিজেদের মত কিছু পরিকল্পনা করা প্রয়োজন।
এনজিও গুলোকে টিকে থাকার জন্য সবার আগে প্রয়োজন প্রতিষ্ঠান এ কর্মরতদের মনোবল বৃদ্ধি করা। যারা সরাসরি ফিল্ডে কাজের সাথে জড়িত তাদের পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য নিরাপত্তা প্রদান। প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সুরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহ করা,উৎসাহ প্রদান ও নিরাপত্তার বিষয়ে আশ্বাস বা নিশ্চয়তা প্রদান করা। এই সংকটকালীন সময়ে সংস্থার প্রতি পজিটিভ মনোভাব গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় মোটিভেশান তথা আগামী ভালো সময়ে সংস্থা কর্মীদের বর্তমান সময়ে পাশে থাকার অবদান মনে রাখবে এটা বিশ্বাস করানো। কর্মীদের চাকরির নিশ্চয়তা প্রদান করে আশ্বস্ত করা।
মনে রাখা দরকার একটা ভালো মোটিভেশান পারে একটা ভালো আগামী দিতে। কর্মীদের মতামত গ্রহণ ও সিদ্ধান্ত নিতে সময় ও স্বাধীনতা প্রদানের মধ্য দিয়ে সংস্থার পোর্টফলিও অনুযায়ী কম বেতন,বেতন বৃদ্ধি করা, না করাসহ যে কোন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ সংস্থার জন্য মঙ্গলজনক। কোন অবস্থায় কর্মী ছাটাই কোন ভালো সিদ্ধান্ত হতে পারে না। তারপরও অপ্রয়োজনীয়, মেধাহীন, বোঝা সরুপ কর্মী ছাটাই করে সংস্থার ব্যয় কমাতে হলে তাকে সুযোগ প্রদান, অন্য উপার্জনে যাবার জন্য প্রয়োজনীয় সময় চলার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ প্রদান বা সহযোগিতা করে করোনাকালে সর্বোচ্চ মানবিক আচরণ যেমন সবার প্রত্যাশা, তেমনি সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ।
দুর্যোগকালীন কমিটি গঠন করে নিরাপত্তা ও কার্যক্রম পরিচালনা বিষয়ে বিশেষ যোনে ভাগ করে তদারকি ও শান্তিপূর্ণ প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করা।
এতে করে যে সকল এনজিও লোন আদায় করছে তাদের আদায় হার বাড়বে বলে আমার বিশ্বাস।
ফিল্ড পর্যায়ে পর্যাপ্ত সম্পর্ক উন্নয়ন করা দরকার। মনে রাখা দরকার ভালো সম্পর্ক, ভালো ব্যবহার ছাড়া এই সংকটকালে সংকট মোকাবিলা সম্ভব নয়। আপনার বৈরী আচরণ সংকটকে আরো উস্কে দিতে পারে। যে সংস্থা ফিল্ডে সম্পর্ক উন্নয়নে যত বেশি ভূমিকা পালন করবে, আগামী দিনে বাজার দখলসহ বর্তমানে টিকে থাকার যুদ্ধ তাদের জন্য তত সহজ হবে।
করোনাকালে সচল প্রকল্প খুঁজে বের করতে হবে। নতুন নতুন উয়িং সৃষ্টি করতে হবে, যা আয় বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। আগামী দিনে প্রবাসী আয় কমবে, ঝরে পড়বে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এ সময় মানুষ ফিরবে শেকড়ে- বাড়বে কৃষি নির্ভরতা, পশুপালন ও ঘরে বসে অনলাইনে ভিত্তিক ব্যবসায়। এ সময় এনজিও গুলোকে সময়ের সাথে তাল রেখে বিকল্প খুঁজতে হবে। বর্ষাকালে মোমবাতির ব্যবসার মত এনজিওকে খুঁজে নিতে হবে বিকল্প ব্যবসায়ীক চিন্তা। কারণ বসে বসে জমানো পুঁজি ভেঙে খেলে প্রতিদিন কমতে থাকবে ব্যয় অতিরিক্ত আয়। তাই ঝুঁকি নিতেই হবে। মাইক্রো ক্রেডিট নিয়ে যারা কাজ করছে তাদের মনে রাখা দরকার ঝুঁকি না নিলে বিতরণ বন্দ রাখলে জ্যামিতিকভাবে কমতে থাকবে আয়। দিন দিন আদায় হারও কমতে থাকবে।
ফিল্ডে লোন আদায় করা বা প্রকল্পের কাজ করার জন্য ডিজিটালাইজেশন সুবিধা, অনলাইন, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের, যেখানে যেটা প্রয়োজন তার সহায়তা নিতে হবে। যদিও তার জন্য মানুষকে অভ্যস্ত করতে হবে,যাতে সময় লাগবে। তারপরও চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে কারণ আগামী দিনে মানুষ ক্রমশ ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করবে। তাছাড়া সহসা যাচ্ছে না করোনাকাল।
স্থায়ী সম্পদও সম্পত্তিসহ সৌখিন ব্যয় কমাতে হবে। এই সময়ে স্থায়ী সম্পদও সম্পত্তি সৃষ্টি করে আয়ে প্রভাব ফেলা মোটেই ঠিক হবে না,যদি না তা অতি প্রয়োজনীয় হয়। সৌখিন ব্যয় কমাতে হবে। ধরুন আপনার একটি শাখা অফিস জেলা শহরে ভাড়া নেয়া আছে ১০ হাজার টাকায়, হয়তো তার পাশের বিল্ডিংয়ে প্রোগ্রামের কোন ক্ষতি না করে ৮ হাজার টাকায় ভাড়া পাওয়া যাবে। নাইট হোল্ড করে ভিজিট করলে যদি তা প্রতিক্রিয়াশীল না হয়- শুধুমাত্র খরচ বাড়ে তবে তা না করায় ভালো। শুধুমাত্র দুটি উদাহরণ দিলাম বাকিটা প্রতিটি এনজিও তার নিজস্ব পলিসি ও পরিকল্পনা বিভাগের বিষয়।
লোন বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানে শুধুমাত্র সঞ্চয় আছে এমন সদস্যদের বিষয়ে ভাবার অবকাশ রয়েছে।
এভাবে প্রতিটি এনজিওকে ভাবতে হবে তাদের নিজস্ব পরিমন্ডলে কিভাবে ব্যয় কমানো যায় এবং বিকল্প উপায়ে আয় বৃদ্ধি করে কিভাবে টিকে থাকা যায়।
সর্বপরি বাংলাদেশের ৯৫ ভাগ ক্ষুদ্র ব্যবসা দাড়িয়ে আছে মাইক্রো ক্রেডিট এর উপর, যার মধ্যে ৬০ ভাগ অপ্রাতিষ্ঠানিক। তাই আগামী দিনের বাংলাদেশেকে এগিয়ে নিতে এনজিও গুলোকে টিকে থাকতে হবে। জয়ী হতেই হবে টিকে থাকার যুদ্ধে।
লেখকঃ উন্নয়নকর্মী ও ফ্রিল্যান্সার।